বাংলার নতুন বছরকে বরণ করে কলকাতা ময়দানে প্রতিবার বারপুজো উৎসবে মেতে ওঠেন ফুটবলপ্রেমীরা৷ তাই পয়লা বৈশাখে ভোরের আলো ফুটতেই সবাই ছুটে আসেন তাঁদের প্রিয় ক্লাবে৷ কলকাতার রাজপথ ময়দানমুখি হয়ে ওঠে৷ বারপুজোর তৎপরতায় নতুন পোষাকে হাজির হন ক্লাবে৷ সেই আবেগ ও আন্তরিকতায় মোহনবাগান ক্লাবে এবার সবচেয়ে বড় উপহার অইএসএল ফুটবলে দ্বিমুকুট, কলকাতা হকি লিগে চ্যাম্পিয়ন আর সবুজ-মেরুন ছোটরা ভারতসেরা৷
ঐতিহাসিক সাফল্যে মোহনবাগান সমর্থকরা আনন্দে-উচ্ছ্বাসে সারাদিনটাকে মিলন মেলায় পরিণত করেছেন৷ ক্লাব লনে শোভা পেয়েছে সব ট্রফি৷ মঞ্চ ফুল দিয়ে অপরূপ সাজে সেজে উঠেছিল৷ সমর্থকরা ট্রফি জড়িয়ে ছবি তুলেছেন৷ সমবেত কণ্ঠে শোনা গিয়েছে মোহনবাগানের জয়ধ্বনি৷ ভিড় করেছেন প্রাক্তন ফুটবলার থেকে বর্তমান খেলোয়াড়রা৷ মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্ত একেবারে বাঙালি পোশাকে বারপুজো অঞ্জলিতে অংশ নিলেন৷ সঙ্গে তরুণ ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস৷ কালীঘাট থেকে আসা পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে প্রাক্তন দুই ফুটবলার অর্জুন প্রসূন ব্যানার্জি ও সুব্রত ভট্টাচার্য সবুজ-মেরুন ব্রিগেডের জয়ের ধারাকে ধরে রাখার জন্য প্রার্থনা করলেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমাট বেঁধেছে৷ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-ফুটবলাররা মিলন উৎসবে সংহতির পরিচয় দিলেন৷ মোহনবাগান তার ঐতিহ্যে কোনওরকম ঘাটতি রাখেনি৷ চিরাচরিত সেই পানতুয়া খাবার টেবিলে দেখতে পাওয়া গেল৷
আসলে এবারের পয়লা বৈশাখে বারপুজোয় আলাদা একটা উৎসাহ কথা বলেছে৷ সবার মুখে মুখে ভারত সেরার সেরা দিনটার কথা৷ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে সেই মায়াবী রাত রূপকথার কাহিনি৷ আলোর রোশনাই আর আতসবাজির শব্দে সবাই উত্তাল৷ মোহনবাগান অইএসএল ফুটবলের কাপ ফাইনালে ২-১ গোলে বেঙ্গালুরু এফসি’র দর্পচূর্ণ করে বাজিমাত করল৷ লিগ-শিল্ডের পাশে কাপ জয়ে এক ঐতিহাসিক অধ্যায় মোহনবাগানের কাছে৷ গত মরশুমে কাপ ফাইনালে মুম্বই এফসি-র কাছে হারটা বারবার সবার বুকে যন্ত্রণার তীর বিদ্ধ করছিল৷ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সমর্থকরা আনন্দে অঝোরে কেঁদেছেন৷ আলবার্তো রদ্রিগেসের আত্মঘাতী গোলে মোহনবাগান পিছিয়ে পড়লেও, মোহনবাগানের লড়াকু ফুটবলাররা কোনও সময়ের জন্যে লড়াই থেকে সরে থাকেননি৷ তারপরে কোচ হোসে মোলিনার কৌশলের কাছে বিধ্বস্ত হতে হল সুনীল ছেত্রীদের৷ শুভাশিস বসু, জেসন কামিন্স, মনবীর সিং, লিস্টন কোলাসো থেকে সুরু করে জেমি ম্যাকলারেনরা বাঘের মতো আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ সেই আক্রমণকে সামাল দিতে গিয়ে গোল বক্সের মধ্যেই চিংলেনসানা সিং বল হাত দিয়ে থামাতেই রেফারি পেনাল্টির নির্দেশ দেন৷ জেসন কামিন্স স্পট কিক থেকে গোল করে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনতেই সমর্থকরা উৎসবে মেতে ওঠেন৷
নির্দিষ্ট সময়ে ফলাফলে কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় অতিরিক্ত সময়ে গড়িযে যায় খেলা৷ মোহনবাগানের সাহসী ফুটবলাররা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকেন৷ আক্রমণের ঝড় অনবরত সুনামির মতো আছড়ে পড়তে থাকে৷ তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বেঙ্গালুরু দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের৷ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বকাপার জেমি ম্যাকলারেন মারাত্মক ভূমিকা নিয়ে আক্রমণ গড়ে তুলতে থাকেন৷ সেই মুশকিল আসান ম্যাকলারেন দুরন্ত গোল করে মোহনবাগানকে কাপ উপহার দিলেন৷ তাই খেলা হতেই ম্যাকলারেন-শুভাশিসরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন৷ সবুজ-মেরুন আবিরে মাখামাখি সমর্থকরা৷ রংমশালের আলোয় সকল ফুটবলার থেকে কোচ-কর্মকর্তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন গর্বের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে মোহনবাগান নাম লিখিয়ে ফেলল৷ ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগান বলতেই গৌরবের৷ অনন্য শক্তির৷ সম্মান ও ঐতিহ্যের আলোময় মোহনবাগান৷
আইএসএল ফুটবলে সেইভাবে ইস্টবেঙ্গল নিজেদের প্রকাশ করতে না পারলেও, বারপুজো উৎসবে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে উপচে পড়েছিল ভিড়৷ একঝাঁক প্রাক্তন ফুটবলারদের উপস্তিতিতে পরিবেশ চাঁদের হাটে পরিণত হয়েছিল৷ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রশান্ত ব্যানার্জি, মেহতাব হোসেন, সুলে মুসা ও অমিত ভদ্ররা আলো করে আড্ডায় মজেছিলেন৷ দলের নতুন অধিনায়ক মহেশ সিংয়ের নাম ঘোষণা করা হয়৷ ক্লাবের শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার আগামী দিনে সাফল্যের বার্তা দিলেন৷ ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বেশ কিছুক্ষণ ইস্টবেঙ্গলে সময় দিযেছিলেন৷
আর এবারে বারপুজোয় ভারতের ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলিকে ময়দানে দেখতে পাওয়া গেল৷ এরিয়ান, মেসারার্স ক্লাব হয়ে ভবানীপুর ক্লাবে সবার সঙ্গে দেখা করলেন৷ ভবানীপুর ক্লাবে দেখা গেল শিশির ঘোষকে৷ আইএফএ-র সভাপতি অজিত ব্যানার্জিকে দেখা গিয়েছে ময়দানের বিভিন্ন ক্লাবে৷ কালীঘাট স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব স্বপন ব্যানার্জি দৃষ্টিহীনদের বিশেষ উপহার দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেন৷ সাদার্ন সমিতি ও খিদিরপুর ক্লাবেও বর্ষবরণে বারপুজো উৎসবে কত মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ল৷ এটাই কলকাতা ফুটবলের মাহাত্ম্য৷ বন্ধুত্বের পরিচয়৷ সংহতির মিলন উৎসব৷